ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্লাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম (ডিপিএফ)। এই ফোরামের কার্যক্রমের কেন্দ্রে রয়েছে বাল্যবিয়ে রোধ করা। পুরোদমে কাজ শুরু করার আগে ২৭ এপ্রিল থেকে ডিপিএফ সদস্যদের জন্য ১৫ দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক আরেকটি কর্মশালায় ডিপিএফ সদস্যরা সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ সম্পর্কে বিশদভাবে জেনেছেন। সিটিজেন'স চার্টার, তথ্য অধিকার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার মতো উপকরণগুলো সরকারের জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ও সুশীল সমাজ – দুটোকেই শক্তিশালী করতে ভূমিকা পালন করে। বাল্যবিয়ে রোধ ছাড়াও শিক্ষার মানোন্নয়ন ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মানোন্নয়নে দেশের বারোটি জেলায় কাজ করছে পিফরডি। ডিপিএফ সদস্যরা মনে করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাল্যবিয়ের হার উদ্বেগজনক। এ কারণেই তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
ফোরাম গঠনে ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর খোদেজা বেগম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশজন সদস্যের এই ফোরামে রয়েছেন সাংবাদিক, শিক্ষক এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিগণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই ফোরামে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন নিলুফা ইয়াসমিন। এছাড়াও, রয়েছেন মোহাম্মদ আরজু মিয়া যার ‘বাল্যবিবাহ’এর সমস্যা নিয়ে পূর্বেও কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
ফোরামের সদস্য মোহাম্মদ মাহবুব খান বাল্যবিয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেন। তার মতে, ধর্মান্ধতা ও শিক্ষার অভাব এই সমস্যার মূল কারণ। “আমাদের জেলার মানুষ ধর্মের প্রতি অন্ধভাবে আচ্ছন্ন,” বলছিলেন মাহবুব।
চলমান অতিমারী বাল্যবিয়ের হারের আশঙ্কাজনক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। লকডাউনের সময় অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ভিকারুন নেসা বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন দারিদ্র্যকে। তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসী পাত্ররা বিয়ের প্রস্তাব দিলে মেয়ের বাবা-মায়েরা তাদেরকে হাতছাড়া করতে চান না। আবার দেখা যায়, বাবারা বিদেশে থাকলে মায়েরা মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন হওয়ায় তারা মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। মেয়েরা স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কিংবা অন্য কাজে বাইরে গেলে প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। ফলে মেয়েকে বিয়ে দেয়াটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান মনে করে পরিবার।” তার মতে, যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাল্যবিয়ে কমানো সহজ হবে না।
ডিপিএফের কার্যক্রমের প্রশংসা করে এই কর্মকর্তা বলেন, বাল্যবিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদেরকে তৃণমূলে আরো বেশি কাজ করতে হবে। ডিপিএফের সফলতম কার্যক্রমের মধ্যে কাজীদের বাল্যবিয়ে বিরোধী শপথগ্রহণের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এই অনুষ্ঠানে কাজীরা অঙ্গীকার করেন যে, তারা কোনো বাল্যবিয়ে পড়াবেন না। বরং, বর-কনের বয়স নিয়ে কোনোরকম সন্দেহ হলেও প্রশাসনকে জানাবেন। জেলার বিভিন্ন মসজিদের ইমামের কাছ থেকেও একই রকম অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। কারণ, অনেক অভিভাবক ইমামদের সহায়তায় কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণপত্র ছাড়াই ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেন।
এসব বিষয়ই ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সংলাপে উঠে আসে। ডিপিএফের সদস্য ছাড়াও সংলাপে স্থানীয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকদ্বয়, জেলা বিয়ে নিবন্ধক, কাজী ও ইমামসহ সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে জেলা বিয়ে নিবন্ধক ও কাজী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে কাজীরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে নিবন্ধন না করার অঙ্গীকার করেন।
২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ডিপিএফ সদস্য মোহাম্মদ আইয়ুব খান জন্মসনদ তৈরির সময় টিকাকার্ড ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। অনেকেই মেয়ের বিয়ে দিতে জন্মসনদ জাল করে বয়স বাড়িয়ে দেখান। ১৯৮৮ সাল থেকে জন্মের পর পরই প্রত্যেক শিশুকে ছয়টি করে টিকা দেয়া হয়। তাই ভুয়া জন্মসনদের ব্যবহার কমাতে টিকা কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধির সুপারিশ করেন এই শিক্ষক।
নারীদের উৎসাহিত করার জন্য ডিপিএফ আয়োজিত গণশুনানিতে নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প বলেছেন হালিমা মোর্শেদ কাজল। তার বিয়ে হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। তবে তার স্বামী তার প্রতি সহমর্মী ছিলেন। যে কারণে, একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর পর এবং চার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার পরও সম্প্রতি তিনি কলেজে ভর্তি হতে পেরেছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি নারীদেরকে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ৩৫ জন কর্মী কাজ করছেন।গণশুনানিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণের আলোকে পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি ও সরকারি হাসপাতালে সেবার মানের বিষয়েও আলোচনা করা হয়।
ডিপিএফ সভাপতি আরজু মিয়া বলেন, ফোরামের কাজ নিয়ে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী। তারা বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। ফোরামের প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ সামাজিক জায়গা থেকে কাজ করছেন। তাদের মতে, বাল্যবিয়ের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রকল্পের সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে হলে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের তুলনায় মাঠপর্যায়ে বেশি কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
বাল্যবিয়ে বিরোধী লড়াই আরো জোরদার করতে জেলার সকল কাজীকে নিয়ে একটি বৈঠক করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান আরজু মিয়া। তিনি বলেন,
“পিফরডি প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও আমরা সমাজ থেকে এই অভিশাপ দূর করতে কাজ করে যাব। সাধারণ মানুষ সচেতন হলেই বাল্যবিয়ের হার কমানো সম্ভব।”
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।
Comments