নলকূপের অভাবে চন্দনপুর কবি কফিলউদ্দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া, সেখানে যাওয়ার রাস্তাটিও ছিল অত্যন্ত অত্যন্ত খারাপ। জামালপুর ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম (ডিপিএফ) আয়োজিত একটি বৈঠকে ফোরামের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বিষয়গুলো উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে জানালে তিনি যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন।
জামালপুর জেলার সাধারণ মানুষ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে সদ্য গঠিত এই ডিপিএফ। জনসাধারণকে সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো সম্পর্কে জানানোর পাশাপাশি জামালপুরের প্রধান সামাজিক সমস্যা, অর্থাৎ, বাল্যবিয়ে রোধের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় ফোরামের কার্যক্রম। সরকারি কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে অনলাইন ও অফলাইনে সংলাপ আয়োজন করেছে জামালপুর ডিপিএফ। এখন এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রদত্ত সেবাগুলোর ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠছেন এবং সেবার জন্য সেখানে যেতে আগ্রহীও হচ্ছেন।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সহায়তায় প্লাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পেরই একটি নতুন উদ্যোগ হলো ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম গঠন। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ – সিটিজেন’স চার্টার, তথ্য অধিকার, ২০০৯, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুশীল সমাজ ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে এই ফোরাম। দেশের ১২টি জেলায় পিফরডি প্রকল্পের আওতায় এমন ১২টি পলিসি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করে চলেছে জেলাভিত্তিক এসব ফোরাম। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ ব্যবহার করে সহযোগিতামূলক ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা। এই ফোরাম গঠনে জামালপুর জেলার পিফরডি প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর মোঃ শফিকুজ্জামান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, “সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আছে এমন ব্যাক্তিদেরই আমি ফোরামের সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছি। কারণ সমাজে তাদের কাজের প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও, সদস্য হওয়ার জন্য যেসব যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন তাও তাদের আছে। অনেককে তাদের ম্যাপ (মাল্টি একটর পার্টনারশিপ) মেম্বার হিসেবে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে নির্বাচিন করা হয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকসহ নানা পেশার সুশীল সমাজ সংস্থার সদস্যদেরও আমরা এ ফোরামে নির্বাচিত করেছি।“
“সাধারণ মানুষ এখন কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাগুলো সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে। ফলে আমাদের এই ক্লিনিকে এখন প্রতিদিনই কমবেশি রোগী আসছে,” বলছিলেন কবি কফিলউদ্দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী নাজমুল আলম। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার জানান, প্রতিদিনই ৫-৭ জন নারী এসে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চান এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি কিংবা ইঞ্জেকশন নিয়ে যান। পলিসি ফোরাম মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হলেও ক্লিনিকের আসল মালিক জনগণ। যখন তারা বুঝতে পারলেন যে এটি স্থানীয় মসজিদ-মন্দির কিংবা স্কুলের মতোই আরেকটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, তখন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে টাকা তুলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য একটি তহবিল গঠন করলেন। বড় কিছু না হলেও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উন্নয়নে তারা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। এটাই বা কম কিসের!” বলছিলেন আবুল কালাম আজাদ। ডিপিএফের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উদ্যোগের সাফল্য হিসেবে তিনি রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী হওয়ার প্রবণতাকে উল্লেখ করেন।
একটি সিটিজেন’স চার্টারের পাশাপাশি ছোট্ট এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি অভিযোগবাক্সও আছে। ফলে রোগীরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিষয়ে তাদের অভিযোগ ও পরামর্শ জানাতে পারেন অভিযোগ বাক্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে পারছে। ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যগণ জানান, ফোরামের আয়োজিত সংলাপ থেকে তারা তথ্য অধিকার আইন, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার মতো সামাজিক জবাবদিহিমূলক উপকরণগুলো সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও পেটব্যথায় ভুগছিলেন এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বাসিন্দা শামসুল হক। ক্লিনিকের পাশে বাড়ি হওয়ায় ওষুধ সংগ্রহ করা তার জন্য তেমন কঠিন কিছু নয়। “এই বয়সে নানারকম অসুখ-বিসুখ হওয়াটাই স্বাভাবিক। শরীরে কোনো সমস্যা বা অসুবিধা দেখলেই কমিউনিটি ক্লিনিকে চলে আসি। এখানকার ডাক্তার সাহেব বেশ ভালো মানুষ। ওষুধ দেয়ার আগে তিনি আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনেন। সবসময়ই এখান থেকে ওষুধ খেয়ে উপকার পেয়েছি,” বলছিলেন শামসুল হক। তিনি আরো জানান যে বাড়ির পাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকায় তাকে কষ্ট করে শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হয় না।
জেলা সিভিল সার্জন ডা: প্রণয় কান্তি দাস বলেন, জামালপুরে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে। তিনি বলেন, “ডিপিএফ সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করাটা দারুণ লেগেছে।” আগে জেলার এক চতুর্থাংশ শিশুর জন্ম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হতো বলেও জানান প্রণয় কান্তি। তার মতে, জেলায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুজন্মদানের হার কমাতে ডিপিএফের কার্যক্রম দারুণ ভূমিকা পালন করেছে। “ডিপিএফ সদস্যরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করেছেন এবং স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি নারীদের উৎসাহিত করেছেন।” অনেকসময় মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দরকার হয় না। তাছাড়া অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই সামগ্রিক অবস্থার বিচারে গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি উৎসাহিত করা হয়। জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাজহারুল হক চৌধুরী বলেন, ডিপিএফ সদস্যরা গর্ভবতী নারী ও তাদের পরিবারকে স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। ইতোমধ্যেই তাদের প্রচেষ্টার সুফল দেখা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক হিসেব অনুযায়ী, জেলার প্রতি ১২০টির মধ্যে মাত্র ৯টি শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নিচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় তারা এখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিভিন্ন সেবার বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ জানান। ডা. প্রণয় কান্তি বলেন,
“কিছুদিন আগে আমি অভিযোগ পেয়েছিলাম যে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকে। বিষয়টি জানার পর আমি একদিন সেখানে গিয়ে ওই সমস্যার সমাধান করে আসি। এখন আর স্বাস্থ্যকর্মীরা ফাঁকি দেন না। এতে এলাকাবাসীও বেশ খুশি,”
বলছিলেন জেলা সিভিল সার্জন।
মহামারির কারণে ফোরামের কার্যক্রম সীমিত হয়ে এলেও তারা প্রচারণাসহ যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন সাধ্যমত। ফোরামের সদস্যরা মিশ্র পদ্ধতিতে (অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে) বৈঠক, সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা চালিয়েছেন। সেসব কার্যক্রমে বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের কর্মকর্তাগণও উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে সেবাদাতা ও গ্রহীতারা সরাসরি বিভিন্ন সমস্যা ও সেগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন, যা এর আগে কখনো হয়নি বললেই চলে।
ক্লিনিকের ভাঙা রাস্তার বিষয়ে অভিযোগের জবাবে স্থানীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি সেটি দ্রুত সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফোরামের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে ডিপিএফ সভাপতি শামিমা খান কাজ করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়টিই বেছে নিয়েছেন, যা করোনা মহামারিকালীন সময়ে স্থানীয় বাসিন্দাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে।
ফোরামের কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে একটি বৈঠকও অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছেন শামিমা খান। সেইসাথে তাদের বেতন বাড়ানোর ব্যাপারেও চেষ্টা করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। কেননা, গত ১০ বছরেও তাদের বেতন বৃদ্ধি পায়নি। “তারা গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সেবা করেন। আমাদেরও উচিৎ তাদের বিষয়টি ভেবে দেখা। তাহলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো সুন্দরভাবে চলবে,” বলছিলেন শামিমা।
ফোরামের কার্যক্রমের মাধ্যমে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন জামালপুরের ডিপিএফ সদস্যগণ। ডিপিএফ তাদেরকে দারুণ এক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। এমন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে ফোরামের সকলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।
Comments