ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সহায়তায় প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পেরই নতুন উদ্যোগ হলো ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ – সিটিজেন চার্টার, তথ্য অধিকার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুশীল সমাজ ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে এই ফোরাম। দেশের ১২টি জেলায় পিফরডির আওতায় এমন ১২টি পলিসি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করছে জেলাভিত্তিক এসব ফোরাম। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ ব্যবহার করে সহযোগিতামূলক ও ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতিতে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা।
শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী, আইনজীবী ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি সহ ২০ জন সদস্যের সমন্বয়ে ডিপিএফ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেন পিফরডি প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা অমর ডিকস্তা। ডিপিএফ সদস্যদের জেলা-ভিত্তিক এনজিও বা সিএসও বা পার্টনার সিএসও বা মাল্টি-অ্যাক্টরস পার্টনারশিপ (এমএপি) গ্রুপ প্রতিনিধি, বা সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অন্যান্য নির্দিষ্ট মানদণ্ডের মধ্যে থেকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ফোরামে স্থানীয় সরকারের অন্তত একজন প্রতিনিধি থাকার শর্ত ছিল। ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারকে সদস্য নির্বাচিত করার মাধ্যমে সে শর্ত ভালোভাবেই পূরণ হয়েছে নাটোর ডিপিএফ। তিনি, এবং সহ-সভাপতি মোসাম্মৎ পারভীন আক্তার ছাড়াও এই ফোরামে আরও পাঁচজন নারী রয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের জেলা নাটোরে ডিপিএফ সদস্যরা বাল্যবিয়ে রোধের বিষয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
“বাল্যবিয়ের হারে সারাদেশের মধ্যে নাটোর দ্বিতীয়। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,”
বলছিলেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শিবলী সাদিক।
ডিপিএফের কার্যক্রমকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাদিম সরোয়ার বলেন, “এই ফোরাম সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মানুষদের কাছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে।”
ডিপিএফের বেশ কিছু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র মনোয়ার হোসেন। নাদিম সরোয়ারের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় তার কথায়। তিনি বলেন, “আমরা এখন জানি, সরকারি সেবা পাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার এবং সেগুলো না পেলে অভিযোগ দাখিলেরও সুযোগ আছে।” তিনি আরও বলেন, “কিছুদিন আগে আমি জন্ম সনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে গেলে তারা আমার কাছ থেকে বাড়তি টাকা দাবি করেন। আমি সিটিজেন চার্টারে উল্লেখিত ফি-র কথা বলতেই তিনি চুপ হয়ে যান। তখন আমি মাত্র ৫০ টাকায় আমার জন্ম নিবন্ধন বুঝে পেয়েছি।”
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ জানান, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ( যেখানে সাধারণত ঘটনাস্থলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সংক্ষিপ্ত রায় এবং সাজা প্রদান হয়) সর্বদাই সচেষ্ট। তিনি বলেন, “ডিপিএফ সদস্যদের কাছ থেকে আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি। তারা এ বিষয়ে নানারকম তথ্য দিয়ে আমাদেরকে উৎসাহিত করছেন।”
দীঘাপতিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মো: আবু কালাম এই ফোরামের সাথে কাজ করতে পেরে বেশ আনন্দিত। তিনি বলেন, “অন্য কোনো সংগঠনের সাথে এমন কাজ করার সুযোগ হয়নি আমার।” ফোরামের কার্যক্রমে তার অবদানের বিষয়ে এই ইমাম বলেন, “আমি অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যেন শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগে মেয়েদের বিয়ে না দেন।”
শুক্রবার জুম্মার খুতবায় সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন আবু কালাম। তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব উপকরণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। “আমি মুসল্লিদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, ইসলামে তথ্যের অবাধ প্রবাহ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।”
নববিধান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজা খানম জেসমিন ডিপিএফের ৩টি কর্মসূচিতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন এবং দুটিতে অনলাইনে অংশগ্রহণ করেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি ফোরামের প্রতি কৃতজ্ঞ।
“আমার শিক্ষার্থীরা বাল্যবিয়ের শিকার হলে করণীয় সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ফোরামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আমি করণীয় সম্পর্কে জানতে পারি। সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং বাল্যবিয়ের ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দিক থেকে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।”
ডিপিএফের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর কয়েকজন সহকর্মীকে সাথে নিয়ে জেসমিন কয়েকটি কাউন্সেলিং সেশনের আয়োজন করেন। এসব সেশনে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বাল্যবিয়ের নানারকম কুফল বুঝিয়ে বলেন। এছাড়া তিনি তার ছাত্রীদেরকে সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। মুখে গর্বের হাসি ফুটিয়ে তিনি বলেন,
“আপনি আমার স্কুলে এসে দেখে যেতে পারেন, আমার শিক্ষার্থীরা কতটা সচেতন এসব বিষয়ে।”
ফোরামের কাজের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, ধনী ও প্রভাবশালী পরিবারের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এধরনের কাজে আগ্রহ দেখা যায় না। দীঘাপতিয়া এমকে কলেজের এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, “এসব উদ্যোগে আপনি মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদেরই বেশি দেখবেন।”
নাটোর ডিপিএফ প্রতি মাসে ডিপিএফ সদস্যদের কাছ থেকে ২০০ টাকা সংগ্রহের মাধ্যমে একটি তহবিল গঠন করেছে যাতে তারা ভবিষ্যতে কোনো অভিভাবক সংস্থার তহবিল ছাড়াও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে নাটোরকে বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিপিএফ সদস্যরা স্থানীয় সম্প্রদায়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য উন্মুখ।
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।