আদর্শ মানব সেবা সংস্থার পরিচালক ও পটুয়াখালী ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরামের সদস্য আফরোজা আকবর। কাজের বিষয় হিসেবে শিক্ষার মানোন্নয়নকে বেছে নেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“পটুয়াখালীতে প্রায় ২০৯টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ১২৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। তবে এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনোরকম সমন্বয় কিংবা যোগাযোগ নেই। এই জেলায় শিক্ষা নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে বলেই আমরা এ বিষয়টি বেছে নিয়েছি। আমরা স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছি।”
ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সহায়তায় প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পেরই নতুন উদ্যোগ হলো ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ – সিটিজেন চার্টার, তথ্য অধিকার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুশীল সমাজ ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে এই ফোরাম। দেশের ১২টি জেলায় পিফরডির আওতায় এমন ১২টি পলিসি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করছে জেলাভিত্তিক এসব ফোরাম। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ ব্যবহার করে সহযোগিতামূলক ও ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতিতে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা। শিক্ষক, সাংবাদিক, স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য, জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ২০ জন সদস্য নিয়ে ২০২১ সালের শুরুতে ফোরামটি গঠিত হয়। মহামারীকালে গঠিত হওয়ায় ফোরামের সকল কার্যক্রম অনলাইনেই পরিচালিত হয়।
পিফরডি প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর মো: মহিউদ্দিন বলেন,
“শিক্ষার মানোন্নয়নে ডিপিএফ সদস্যরা শিক্ষা অফিস সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের সাথে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মুজিবুর রহমানের সহায়তায় প্রত্যেক স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, কম্পিউটার ল্যাবের উন্নয়ন ঘটানো এবং ছেলে-মেয়েদের পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।”
ফোরামের কার্যক্রম সম্পর্কে মো: মহিউদ্দিন বলেন, “ডিপিএফ সদস্যরা ছয়টি উচ্চবিদ্যালয়, পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তিনটি মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছেন। তারা ২০টি স্কুলের নিষ্ক্রিয় কমিটিকে সক্রিয় করেছেন।”
আফরোজা আকবরের মতো ডিপিএফ সদস্যদের নির্বাচিত করার মূল ভূমিকায় ছিলেন মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, “ডিপিএফ সদস্য হওয়ার জন্য সাতটি আবশ্যক ও চারটি আকাঙ্ক্ষিত শর্ত ছিল। এই শর্তগুলো বিবেচনা করে আমরা সদস্য নির্বাচন করেছি। এরপর পটুয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের সহায়তায় পজিশন পেপার তৈরি করি। পেপারে আমরা এই জেলায় শিক্ষামানের অবনতির কারণ ও প্রভাব তুলে ধরি।”
স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যাগুলো খুঁজে বের করতে ডিপিএফ সদস্যদের প্রত্যেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তারা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে আলোচনা সভা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নানারকম সমস্যা স্বল্পতম সময়ে সমাধানের বিষয়ে আদেশপত্র জারি করতে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তারা। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মুজিবুর রহমান বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদেরকে চিঠি দিয়েছেন যেন তারা করোনাকালে তাদের প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ল্যাবগুলো কাজে লাগান। এ ধরনের কার্যক্রম ধীরে ধীরে পটুয়াখালীর শিক্ষার মানোন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করেছে।
খাশেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: বশিরুদ্দিন বলেন,
“করোনার কারণে বিশাল এক বিরতির পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল চালু হয়। তবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার পর আবার ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়। ডিপিএফের সদস্যরা শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু অভিনব কাজ করেছেন। কিন্তু স্কুলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াত না থাকায় আমরা সব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারিনি।”
“অবশ্য এরপরও আমাদের অর্জন কোনো অংশে
কম নয়। এর আগে কখনো শিক্ষার্থীদেরকে শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ফোরামের সদস্যরা আমাদের স্কুলসহ কয়েকটি স্কুলে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন।”
তিনি আরও জানান, সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণ সম্পর্কে মানুষকে জানানোর পর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্কুল পরিদর্শন ও তদারকি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিদ্যালয়ের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মো: আবদুল বাশার বলেন,
“ডিপিএফ সদস্যরা আমাদের স্কুলে বেশ কিছু র্যালি ও সেমিনার আয়োজন করেন। শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এসব কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এরপর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আমাদের সবার সাথে বৈঠক করেন। এলাকাবাসী ডিপিএফের মাদকবিরোধী র্যালির প্রশংসা করেছেন। আমার বিশ্বাস, ফোরামের সদস্যরা এভাবে কাজ করতে থাকলে আমাদের জেলায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।”
পিফরডি প্রকল্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শীলা রানী দাস বলেন,
“পিফরডি মানবকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রচার করছে, যা মানব সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ না করলে উন্নয়ন সম্ভব না।”
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিরিন সুলতানা বলেন,
“পিফরডির সকল অংশীদারকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমি অনলাইন ও অফলাইনে কিছু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। তারা আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে কাজ করছেন বলেই আমরা আমাদের কাজের ফাঁকফোকরগুলো পূরণ করতে পারছি।”
ফোরামের সভাপতি মো: আমিনুল ইসলাম বলেন,
“আমার ধারণা আমরা অন্য জেলার চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেছি। করোনাকালে শিক্ষাক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।”
কাজের অগ্রগতি তুলে ধরতে গিয়ে ফোরামের সদস্য মো: দেলোয়ার বলেন,
“আমরা পটুয়াখালী জেলার ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ স্কুলে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা করেছি। এই পরিসংখ্যান শতভাগে উন্নীত করতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মুজিবুর রহমানের মতে, ঝিমিয়ে পড়া স্কুল কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে ডিপিএফ সদস্যরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি বলেন,
“কমিটিগুলো এখন নিয়মিত বৈঠক করে। যেহেতু এই প্রকল্প আজীবন চালু থাকবেনা, সেহেতু কিছু আইন-কানুন তৈরি করার মাধ্যমে এসব বৈঠক নিয়মিত চালু রাখতে হবে। সেইসাথে, সংশ্লিষ্ট সবাই যেন নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। কিছু স্কুলে কমিটির সদস্যরা যথেষ্ট শিক্ষিত নন। আশা করি, জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণী সংলাপে অংশগ্রহণকারী স্কুল কমিটির সদস্যদের জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিবে।”
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব
প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।