top of page

প্রচলিত রীতিকে চ্যালেঞ্জ করঃ ভেঙ্গে ফেল নারীর পথের প্রতিবন্ধকতা | আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২১


গাইবান্ধা জেলায় অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার ওপর মত বিনিময় সভা

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অর্জনকে উদযাপন করা হয়। জেন্ডার সমতা তরান্বিত করতে এবং সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে এই বিশেষ দিন পরিবর্তনের ডাক দেয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী ও পুরুষের সমান অভিগম্যতার বার্তা পৌঁছে দেয়। যাত্রা শুরুর পর থেকেই সারা বিশ্বে বিভন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান একসাথে নারীর অর্জন এবং সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য নানান কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করে থাকে। ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'Choose to Challenge', সমাজের প্রচলিত রীতিকে চ্যালেঞ্জ করা।


‘নেতৃত্বে নারী : কোভিড ১৯ বিশ্বে সমতার ভবিষ্যৎ অর্জন’ কে প্রতিপাদ্য করে জাতিসংঘ এবছর নারী দিবস পালন করছে। সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং কোভিড-১৯ অতিমারি থেকে উত্তরণে সারা বিশ্বে নারী এবং কন্যা শিশুদের ভুমিকাকে এবছর স্বীকৃতি দিচ্ছে জাতিসংঘ। এছাড়াও কমিশন অন দা স্ট্যাটাস অফ উইমেন এর ৬৫ তম অধিবেশনের প্রধান প্রতিপাদ্য ‘জনজীবনে নারী, সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সমান অংশগ্রহণ’ এর সাথেও এবছরের কার্যক্রম সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে জীবনের সকল ক্ষেত্র, সমান মজুরি, বিনা মজুরির সেবা ও গৃহস্থালির কাজে সমান অংশগ্রহণ, নারীর ও কন্যা শিশুর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধ, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রণয়নে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।


নাগরিক অধিকার, বিশেষ করে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে প্ল্যাটফরমস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্প সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি, তথ্য অধিকার, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের মতো সামাজিক জবাবদিহি নিতিমালা প্রবর্তন করেছে। প্রকল্পটি সংলাপ সঞ্চালনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে এবং স্থানীয় ও আঞ্চলিক সুশীল সমাজ সংগঠনের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল এসেছে পিফরডি’র অংশীদারি সংগঠনের বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন সামাজিক অ্যাকশন প্রকল্প (এসএপি) থেকে যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্য বিবাহ নির্মূল করা, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা, সরকারী সেবায় অবাধ অধিকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়া ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে কাজ করা হয়েছে। তাদেরই কিছু গল্প তুলে ধরা হল আজ।


রশিদা বেগম পিফরডি’র অংশীদারি পল্লী সমাজ নারী উন্নয়ন সংগঠন নামে একটি সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দুঃখ-কষ্টের প্রধান দুই কারণ হলো অশিক্ষা ও দারিদ্র্য। আমি সবসময় এই অবস্থা বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখেছি। সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে আমার সংগঠন। আমি খোলাহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলাম। এমনকি কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও ছিলাম। এসব অভিজ্ঞতা আমার কাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।”


এখন পর্যন্ত সংস্থাটি ১৫০ জন নারীকে সেলাই ও হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ১২ জন হিজড়াও অংশগ্রহণ করেন, যা ঐ এলাকার জন্য একটি বিরল দৃষ্টান্ত। “আমরা বাল্যবিবাহ এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করেছি। খোলাহাটিতে কয়েকটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি। বন্যাসহ যেকোনো দূর্যোগের সময়ও মানুষ যেন বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে সেজন্য ৩০টিরও বেশি গভীর নলকূপের পাকা ভিত্তি সংস্কার করেছি”, বলেন রশিদা।



যশোরে সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতির ওপর মত বিনিময় সভা

পল্লী ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, পিফরডি’র আরেকটি অংশীদারি সংগঠন যা নারীর ক্ষমতায়ন, স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, স্থানীয় শাসনব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক এসএম নজরুল ইসলাম যখন বুঝতে পারলেন গ্রামবাসীরা অন্য উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম থেকে খুব একটা উপকৃত হচ্ছে না, তখন তিনি নিজেই একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেন।

নজ্রুল ইসলাম নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন প্রায় বিশ বছর আগে। ইসলাম বলেন, আমরা মহিলাদের জন্য নৈশবিদ্যালয় দিয়ে শুরু করেছিলাম। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা নির্দিষ্ট বাড়ির বারান্দায় হারিকেন জ্বালিয়ে দিত এবং মাদুর পেতে দিত। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৩০ জন পর্যন্ত নারী শিখতে আসতেন।“


তিনি বাল্যবিয়ের শিকার একটি মেয়ের ঘটনা শোনালেন। রাবেয়া নামের এই মেয়েকে তার স্বামী পতিতালয়ে বিক্রির জন্য ভারতে পাচার করে দিচ্ছিল। নিজের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নজরুল মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর মেয়েটির নিজ বাড়িতেই তার পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীতে পরিণত বয়সে আবারো বিয়ে হয় রাবেয়ার। সন্তানের জননী রাবেয়া এখন দক্ষ একজন দর্জি হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, “ওখান থেকে ফিরে না আসতে পারলে আমার যে কি হতো, কে জানে? আমি কৃতজ্ঞ যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছি।“


এই সংস্থা বর্তমানে তিনটি এসএপি’র সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এসএপিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাণীস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা, মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন। এগুলো সবই নারীদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রমের মূল অংশ।



পিফরডি’র অংশীদারি বিশ্বম্ভরপুর রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জান্নাত মরিয়ম নিজের কমিউনিটিতে অবদান রাখার জন্য গৃহিণী থেকে একপর্যায়ে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জের নতুনপাড়া গ্রামের ৩০ জন নারীকে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন মরিয়ম।


সংগঠনের সামাজিক সেবার অংশ হিসেবে প্রতি বছর উপজেলার প্রায় ৫০০ জন নারীকে পুষ্টি ও স্তন্যদান বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে সংস্থাটি পিফরডির স্বাস্থ্য, কর সংগ্রহ, বাল্যবিবাহ ও মাদকাসক্তি বিষয়ক এসএপি পরিচালনা করেছে। মরিয়ম বলেন,


আমি বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ আমি বিশ্বাস করি শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থান এই সামাজিক সমস্যা দূর করতে পারে।“

স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক এসএপির পরিচালক প্রতিমা রানী। তিনি এক মজার গল্প শোনালেন,


“আমরা বসন্তপুরের কমিউনিটি ক্লিনিকে জরিপ করতে গিয়ে দেখি সেখানে আসলে কোন ক্লিনিকই নেই! শুধু কাগজে-কলমেই এই ক্লিনিকের অস্তিত্ব আছে। অথচ সরকারি কাগজপত্র অনুযায়ী, এই ক্লিনিকে ডাক্তারদের বেতন দেয়ার, ওষুধ সরবরাহ করার এবং রোগীদেরকে সেবা দেয়া হচ্ছে। তাহলে কোথায় সেই ক্লিনিক?”

তিনি আরো জানান, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এই খাতের সব অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দমন করা।


নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীকে নিয়ে এ বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক আয়োজন করেন প্রতিমা। তিনি সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে প্রাপ্য ওষুধ সম্পর্কে জানান এবং হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ করার পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলেন, ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারীরা। আমরা নানারকম শারীরিক জটিলতায় ভুগি। ক্লিনিক চালু না থাকলে এসব অসুখ-বিসুখে আমরা কোথায় যাব? তাই এ ব্যাপারে সচেতন করতে আমরা প্রায় ৪০০ জন মহিলার সাথে কথা বলেছি।”


সমাজে বৈষম্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিকূলতা, সেবা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা, সিদ্ধান্ত প্রণয়নে অনুপস্থিতি ইত্যাদি প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে সংগঠনগুলোর সাহস ও আন্তরিকতা, পিফরডি কার্যক্রমের কার্যকারিতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারকার্যে নেতৃত্ব দেয়া নারী পুরষ সবার ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন। নীতিমালা বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পিফরডি ২১ টি জেলায় সহায়তা দিচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় গৃহীত লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় পর্যায়ে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রকল্পটি সহায়তা করছে। পিফরডি অভিগম্যতা এবং জবাবদিহি প্রক্রিয়ার ব্যাবহারের ওপর জোর দিয়ে থাকে।


আন্তর্জাতিক নারী দিবস সার্বজনীন; কোন দেশ, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নয়। এই বিশেষ দিন সম্মিলিতভাবে সবার। আন্তর্জাতিক নারী দিবস কে একান্তই নিজের করে নেয়ার জন্য পিফরডি আপনাদের অনুপ্রাণিত করছে। পরিশেষে, আমাদের অংশীদারি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম এবং সমাজে এর সুফলগুলোকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে নিজের মতো নারী এবং আপনার কমিউনিটিতে পরিবর্তনের সূচনা করতে উদ্বুদ্ধ করছে।

68 views0 comments
bottom of page