top of page

বান্দরবানের ডিপিএফ স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে

Updated: Dec 12, 2022


ছবিঃ বা থেকে - ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর মং শেনুক মারমা, ডিপিএফ সদস্য উসাইন অং মারমা ও আরিফ হোসেন, ডিপিএফ সভাপতি অং চ মং

১১ ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে বান্দরবান ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরামের সভাপতি অং চ মংয়ের ফোনে একটি কল আসে। কলটি রিসিভ করার পর অপর প্রান্ত থেকে একটি স্থানীয় এনজিও ‘অনন্যার’ কর্মী এলি জানালেন, সদর উপজেলার গুংগুরু আগাপাড়ায় ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই গ্রামের বাসিন্দা বরের বয়সও এখনো ২১ বছর হয়নি। তখনই মং থানায় ফোন করে ওসিকে বিষয়টি অবহিত করলেন। সাথে সাথে বান্দরবান থানার ওসির নেতৃত্বে এই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা হয়।


“পরদিন আমি একটি মিটিং আয়োজন করি। সেখানে বর-কনে দুজনের পিতা উপস্থিত ছিলেন। তখন কয়েকজন ডিপিএফ সদস্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ তাদেরকে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বাল্যবিয়ের নানারকম কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে বলি,” বলছিলেন ডিপিএফ সভাপতি অং চ মং। তিনি আরো জানান, সবকিছু শোনার পর অভিভাবকেরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে সন্তানদের বিয়ে না দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হন।


ছবিঃ বাল্য বিয়ে নিয়ে কাজ করার কারণ জানাচ্ছেন ডিপিএফ সভাপতি অং চং মং

ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সহায়তায় প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পটি বাস্তবাইয়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পেরই নতুন উদ্যোগ হলো ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ – সিটিজেন চার্টার, তথ্য অধিকার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুশীল সমাজ ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে এই ফোরাম। দেশের ১২টি জেলায় পিফরডির আওতায় এমন ১২টি পলিসি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করছে জেলাভিত্তিক এসব ফোরাম। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ ব্যবহার করে সহযোগিতামূলক ও ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতিতে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা। মং জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বাল্যবিয়ের চর্চা অত্যন্ত প্রকট। “একারণেই আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি”, বলছিলেন তিনি।


ডিপিএফ সাধারণ সম্পাদক লাল জার লম বমের মতে, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭-তে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন ছিল। “আমার জানামতে, এই আইনে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিয়ে নিবন্ধন ব্যবস্থার অভাবকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে, জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদেরকে কথা দিয়েছেন বিষয়টি তিনি ডিসি সম্মেলনে উত্থাপন করবেন,” বলছিলেন এই ধর্মযাজক।


শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি সহ ২০ জন সদস্যের সমন্বয়ে ডিপিএফ গঠনে মূল ভূমিকা পালন করেন পিফরডি প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা মং শেনুক মারমা। ডিপিএফ সদস্যদের জেলা-ভিত্তিক এনজিও বা সিএসও বা পার্টনার সিএসও বা মাল্টি-অ্যাক্টরস পার্টনারশিপ (এমএপি) গ্রুপ প্রতিনিধি, বা সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অন্যান্য নির্দিষ্ট মানদণ্ডের মধ্যে থেকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ফোরামে স্থানীয় সরকারের অন্তত একজন প্রতিনিধি থাকার শর্ত ছিল। মহিলা কাউন্সিলরদের একজন দীপিকা রাণী তঞ্চঙ্গ্যা কে সহ-সভাপতি নির্বাচিত করার মাধ্যমে সে শর্ত ভালোভাবেই পূরণ হয়েছে বান্দরবান ডিপিএফ। তিনি ছাড়াও এই ফোরামে আরও পাঁচজন নারী রয়েছেন।


কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যার বিষয়ে ফোরামের সভাপতি অং চ মং জানান, পার্বত্য জেলাটিতে দুটি সমান্তরাল প্রশাসনিক কাঠামো থাকায় মূল লক্ষ্য অর্জনে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। “আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করি। কিন্তু এখানে একজন রাজাও (বোমাং সার্কেলের রাজা) আছেন। তিনি এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন। তবে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করছি,” বলছিলেন অং চ মং।


ডিপিএফ গঠিত হওয়ার পর পরই পিফরডি প্রকল্পের জেলা ও আঞ্চলিক কর্মকর্তারা ডিপিএফ সদস্যদের জন্য একটি অনলাইন প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। অর্ধমাসব্যাপী এই প্রশিক্ষণে ফোরামের সদস্যরা অ্যাডভোকেসির নানারকম কৌশল শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথেও পরিচিত হন। ছয়মাস ব্যাপী প্রকল্পে বান্দরবান ডিপিএফের সদস্যরা তাদের বাল্যবিয়েবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে সংলাপ, গণশুনানী সহ বেশ কিছু আলোচনা সভা আয়োজন করেছেন। সেই সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলোর বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার জন্য তারা বিভিন্ন দিবস উদযাপন করেছেন।


২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তারা একটি গণশুনানী আয়োজন করেন। এই অনুষ্ঠানে জনসাধারণ সরকারি কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন সেবার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। বুদ্ধিজ্যোতি চাকমা নামক জনৈক অংশগ্রহণকারী ভূমি কার্যালয়ে সেবার নিম্নমান নিয়ে অভিযোগ করেন। জবাবে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (রাজস্ব) সাইফুল ইসলাম ভূমি কার্যালয়ে লোকবলের ঘাটতির কথা জানিয়ে বিষয়টি প্রতিকারের আশ্বাস দেন, যা দিনশেষে ভূমি কার্যালয়ে সেবার মান ও গতি – দুইই বৃদ্ধি করবে।

“কিছুদিনের মধ্যেই জেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড রুমের সবকিছু আপডেট করা হয়েছে। এখন জায়গা-জমি সংক্রান্ত অনেক সেবা অনলাইনেই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে, অনেক দূরের পাহাড় থেকেও মানুষজন এসব সেবা নিতে পারছেন,” বলছিলেন ডিপিএফ সেক্রেটারি লাল জার।


ডিপিএফ সদস্য উসাইন অং মারমা জানান, “সংলাপে আমরা ডিসি স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, বাল্যবিবাহ রোধ না করতে পারলে সরকারের এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে না। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য বিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না করা হলে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হবে না।” জেলা প্রশাসক ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে সচল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেও জানান উসাইন।

ছবিঃ সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আয়োজিত ডিপিএফের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে বলছিলেন উসাইন অং মারমা।

ডিপিএফের প্রচারণার পর বিভিন্ন বিদ্যালয় অভিভাবকদের কাছে বাল্যবিয়ে বিরোধী বার্তা প্রচার করছে। বান্দরবান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপ্তি কণা বলেন, “ডিপিএফের ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করে আমি যেসব মেসেজ পেয়েছি, সেগুলো আমার ছাত্রছাত্রীদের সাথে শেয়ার করেছি।” তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এখন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে অনেক সচেতন।


কিছুদিন আগে আমি একটা মজার ঘটনা শুনেছি। আমার এক ছাত্রীর মা আমাকে বলেছেন, তিনি তার মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে মেয়ে তাকে পুলিশে দেয়ার হুমকি দিয়েছে,”

বলছিলেন প্রবীণা এই শিক্ষিকা। দীপ্তির বোন বান্দরবান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্মৃতি কণা দে তার শিক্ষার্থীদেরকে বাল্যবিয়ে নিরোধে ব্যবহৃত হটলাইন নম্বরগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন।

ডিপিএফের কার্যক্রম খুব শিঘ্রই বাল্যবিয়ে নিরোধের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে বলেই বিশ্বাস করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মিল্টন মুহুরি। কিশোর-কিশোরী, অভিভাবক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে একই মঞ্চে এনে অভিন্ন বার্তা দেয়ার কারণেই এটি হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।


বাল্যবিয়ে নিরোধের ক্ষেত্রে তাদের অবদান সম্পর্কে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা জানান, “আমরা বাল্যবিবাহকে এক ধরনের শিশু নির্যাতন হিসেবেই গণ্য করি। আমাদের একটি টোল-ফ্রি নাম্বার আছে – ১০৯৮। বাল্যবিবাহ সহ সব ধরনের শিশু নির্যাতন রোধেই আমরা এই নাম্বার ব্যবহার করি।”


পার্বত্য চট্টগ্রামে বাল্যবিয়ে রোধ করা যথেষ্ট সংবেদনশীল ও চ্যালেঞ্জিং হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের প্রচারণার মধ্য দিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছে বান্দরবান ডিপিএফ। পরিবার, সমাজকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন সহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা নিশ্চিত করতেও বদ্ধপরিকর এই ফোরাম।

অদূর ভবিষ্যতে বান্দরবানকে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যধি থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী ফোরামের সদস্যরা।


এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।

42 views0 comments
bottom of page