কর্মসংস্থানের অভাবে নীলফামারী জেলার গ্রামাঞ্চল সবসময়ই মঙ্গাপীড়িত থাকে। দারিদ্র্য এই জেলার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। ফলে শিশু শ্রম এখানে বেশ স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। এখানে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার চেয়ে দৈনিক ২০০ টাকা উপার্জন করাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। বারো-তেরো বছর বয়সের পরই যে কেউ ইপিজেডে কাজ নিতে পারে। তাই প্রচুরসংখ্যক শিশু এই কাজে যোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদেরকে এ কাজে বেশি পাঠানো হয়। ফলে শিক্ষার হার ও মান - দুটোই নিম্নমুখী এই জেলায়। এমন স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও জনগণের চাহিদা বিবেচনা করে এখানে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নীলফামারী ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম (ডিপিএফ)।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের সহায়তায় প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ (পিফরডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পেরই নতুন উদ্যোগ হলো ডিস্ট্রিক্ট পলিসি ফোরাম। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ – সিটিজেন চার্টার, তথ্য অধিকার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুশীল সমাজ ও জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কাজ করছে এই ফোরাম। দেশের ১২টি জেলায় পিফরডির আওতায় এমন ১২টি পলিসি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, বাল্যবিয়ে রোধ ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করছে জেলাভিত্তিক এসব ফোরাম। তাদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ ব্যবহার করে সহযোগিতামূলক ও ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতিতে সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসন ও সুশীল সমাজের মধ্যকার দূরত্ব কমিয়ে আনা। কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে ডিপিএফ মেম্বারদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর শহীদুল ইসলাম ফোরামের প্রেসিডেন্ট হিসেবে গোলাম মোস্তফাকে নির্বাচিত করেন কারণ তিনি আগে থেকেই শিক্ষাঙ্গনের সাথে জড়িত। এছাড়াও জনগণের সাংবাদিক, সিএসও মেম্বার কিংবা ম্যাপ মেম্বারদের মত সমাজে প্রভাবশালী ব্যাক্তিবর্গকে ফোরামের সদস্য করা হয়।
বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রধান চারটি উপকরণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে নীলফামারী ডিপিএফ। বিশেষ করে সেগুলো ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়নের উপায় প্রচার করার চেষ্টা করছে তারা। সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একটি সংলাপেরও আয়োজন করেছে এই ফোরাম। ফোরাম থেকে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কর্মক্ষেত্রে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন ফোরামের সদস্য কলেজ শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন। অধ্যক্ষের সাথে পরামর্শ করে তিনি কলেজে একজন তথ্য কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন যেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা সহজেই সব ধরনের তথ্য পেতে পারেন।
তথ্য কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর মাসুম সরকারের কাছে অনেকেই কলেজের ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফির পরিমাণ ও সেই অর্থ ব্যয়ের খাত সহ বিভিন্ন বিষয় জানতে এসেছেন। ইয়াসমিনের মতে, এটি তথ্য অধিকার চর্চার একটি দারুণ উদাহরণ। তিনি মনে করেন, এই ছোট্ট পদক্ষেপই দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে।
সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো ব্যবহারের উপায় প্রচার করছেন ফোরামের সদস্য সালমা আক্তারও। তিনি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর ভিত্তিতে বড়গাছার ককই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গণপতি রায় তার প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ বাক্স বসানোর উদ্যোগ নেন। তবে প্রথমদিকে শিক্ষক বা স্কুল কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে ইতস্তত বোধ করছিল শিক্ষার্থীরা। পরে একদিন অ্যাসেম্বলিতে বাক্সটির নাম পরিবর্তন করে ‘পরামর্শ বাক্স’ রাখার পর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পরামর্শ আসা শুরু করে। বাক্সটি প্রতি দুই মাসে একবার খোলা হয় এবং পরামর্শগুলো ছাত্র ফোরামের সদস্যদের সামনে পড়ে শোনানো হয়। ছাত্র ফোরামের সদস্য কনিকা বলেন, তাদের ফোরাম শিক্ষার্থীদেরকে মতামত দানে সক্রিয় করতে উৎসাহ দেয়। ফলে স্যানিটেশন সহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও পাঠ্যক্রমের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়।
ডিপিএফ সভাপতি নীলফামারী মডেল কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা। তিনিও তার কলেজে একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করেছেন। তবে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসতে এখনও যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ নয়। অবশ্য নতুন এই উদ্যোগ নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী এই শিক্ষক। তার বিশ্বাস, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলোর বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে তারা তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আরও সচেতন হবে এবং অভিযোগ বাক্সের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন,
“প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরও কার্যকর করা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তবে এজন্য আমাদের কমিটির সদস্যদেরও সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলোর সাথে পরিচিত হতে হবে।”
গোলাম মোস্তফার সাথে একমত পোষণ করেন নীলফামারী কাছারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য মঞ্জুর সরকার। অকপটেই তিনি স্বীকার করেন যে তিনি নিজেই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত নন। “আমাদের এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন শিক্ষার মানোন্নয়ন করা। আর এটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ,” বলছিলেন মঞ্জুর সরকার। সাংবাদিক মো. শীষ রহমান মনে করেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলোর বিষয়ে জানার ফলে স্কুল কমিটির সদস্যরা আরো ভালোভাবে তাদের উদ্বেগ, মতামত ও পরামর্শ তুলে ধরার সুযোগ পাবেন।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. এনামুল হক সরকার বলেন,
“মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে শিক্ষকদেরকে আগ্রহী হতে হবে। নিজেদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করার ব্যাপারে তাদেরকে আরও খোলামেলা হতে হবে। প্রতিটি সরকারি স্কুলে অভিযোগ বাক্স আছে। কিন্তু শিক্ষকরা সমালোচনা বা পরামর্শ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে এসব বাক্স কোনো কাজে আসবে না।”
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আজহারুল ইসলাম বলেন,
“আমরা জানি, জ্ঞানই শক্তি। সুতরাং, সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যত বাড়বে, তত বেশি তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। আর জনগণ সচেতন হলে প্রশাসনও মানসম্মত সেবা দিতে বাধ্য হবে।”
উন্নয়ন সংস্থা সিএডিএএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিপিএফ সদস্য আখতারুজ্জামান বিশ্বাস করেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার উপকরণগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ফলে সাধারণ মানুষেরর সামনে অ্যাক্টিভিজমের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের জন্যও একটি মঞ্চ উন্মুক্ত হয়েছে।
“ধীরে ধীরে মানুষ আরও সচেতন হচ্ছে। এমনকি স্কুলগুলোতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কর্মসূচিসহ সচেতনতা তৈরির ক্ষুদ্রতম উদ্যোগও পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে।”
আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে এই সমাজকর্মী আরো বলেন,
“আমাদের জেলায় শিক্ষার মানোন্নয়নের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। ডিপিএফের কল্যাণে আমরা এখন শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার উপায় জানি।”
এই প্রকাশনাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। প্রকাশনার বিষয়বস্তুর দায়িত্ব প্ল্যাটফর্মস ফর ডায়ালগ প্রকল্পের। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতামতকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।